নির্বিচারে সাপ মেরে ফেলতে থাকলে প্রকৃতিতে দেখা দেবে ভারসাম্যহীনতা। সাপ মেরে ফেললে ইঁদুর বা ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর (রোডেন্ট প্রজাতি) সংখ্যা বেড়ে যাবে। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী তাদের দেহে প্রচুর পরিমাণে মারাত্মক জীবাণুু (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ অনেক অজানা জীবাণু) বহন করে। এসব প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে গেলে এরা মানুষের ঘরে চলে আসবে এবং মানুষ বিরল ধরনের জীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারে। সাপ গবেষকরা বলছেন, নির্বিচারে সাপ মেরে ফেলা বন্ধ করতে হবে। সাপ শুধু মানুষের ক্ষতি করে না, পরোক্ষভাবে উপকারও করে থাকে। সে কারণে না মেরে সাপকে প্রকৃতিতে ফিরে যেতে দেয়াই ভালো। তাছাড়া সাপের বিষ থেকে অনেক ওষুধ তৈরি করা হয়। বিষ না থাকলে উপকারী ওষুধ উৎপাদনও হবে না।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকৃতিতে সব প্রাণীরই প্রয়োজন রয়েছে। সাপও মানুষের জন্য উপকারী। এরা ইঁদুরজাতীয় প্রাণী খেয়ে থাকে। ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকলে ফসলের উৎপাদন বাড়ে। তাছাড়া সাপ শুধু ইঁদুরই খায় না, এরা ব্যাঙ ও অন্যান্য পোকা-মাকড় খেয়ে থাকে। নির্বিচারে সাপ মেরে ফেললে প্রকৃতিতে ইঁদুর, ব্যাঙ ও পোকা-মাকড়ের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং এক সময় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, আমরা সাপের বিষের অ্যান্টিবডি তৈরিতে কাজ করছি। আশা করছি শিগগিরই আমরা তাতে সফল হবো।
নির্বিচারে সাপ না মেরে ফেলতে আহ্বান জানিয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের তত্ত্ব¡াবধায়ক এবং কো-ইনভেস্টিগেটর ড. মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ইদানীং দেখতে পাচ্ছি কোনো এক হুজুগে অনেকে সাপ মেরে ফেলছেন। সাপ না থাকলে প্রকৃতিতে খাদ্য শৃঙ্খল ধ্বংস হবে, বেড়ে যাবে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ এবং ইঁদুর ও ইঁদুরজাতীয় প্রাণী। তাতে ধান ও গমের উৎপাদন কমে যাওয়ার সাথে সাথে জীবাণু সংক্রমণের মতো বড় বড় দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপে দংশন করলেই যে মানুষের মৃত্যু হয়, এই তথ্যটি সঠিক নয়। এ ব্যাপারে ড. মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, সাপটি বিষধর তবে খুব বেশি মারাত্মক নয়। এই সাপের বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভেনম (ওষুধ) আছে। সময় নষ্ট না করে সাপে দংশনের সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারলে আক্রান্তকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে সাপে কাটা এক হাজার ১০০ জনের বেশি রোগী এসেছিল। সাপে কাটা এত মানুষের একজনও মরেনি, সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে অ্যান্টিভেনম দিয়ে।তিনি বলেন, বিষধর সাপও দুই ধরনের দংশন করে। এরা ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ড্রাইবাইট বা বিষ না ঢেলে দংশন করে থাকে। এরা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত না হলে দংশনে বিষ ঢেলে দেয় না। বাংলাদেশে স্থলে বাস করে এমন ৮০ জাতের সাপের মধ্যে কেবল ১২ জাতের সাপ বিষধর। এই ১২ জাতের সাপের দংশনের মধ্যে ৭০ শতাংশ দংশনই থাকে ড্রাইবাইট বা বিষ ছাড়া। ড. আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর সাত লাখের মতো মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। তাদের মধ্যে যারা হাসপাতালে আসতে পারেন এদের মধ্যে মৃত্যু হয় সাত হাজারের মতো। যাদের মৃত্যু হয় এদের বেশির ভাগই কামড় খাওয়ার সাথে সাথেই হাসপাতালে আসেন না। সাপে কাটা মানুষের মৃত্যু হয়েছে এমন মানুষের আত্মীয়স্বজনের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরী পরিসংখ্যান থেকে ড. আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, এই রোগীগুলো ওঝার কাছে ঝাঁড়-ফোক করিয়ে সময় নষ্ট করে পরে হাসপাতালে এসেছেন। যখন আসেন তখন সাপের বিষে শরীরের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়, ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরে রক্তশূন্য হয়ে যায়, সময় মতো অ্যান্টিভেনম দিতে না পারায় এদের কিডনি বিকল হয়ে যায়। এদেরই শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায় না।