পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। পাহাড়-পর্বত, বন জঙ্গল, ছড়া-নদী, গিরি, ঝর্ণা এসব মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবান-বাংলাদেশের এই তিন জেলাকেই মূলত: পার্বত্য চট্টগ্রাম হিসেবে ধরা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন প্রায় ১৩১৮৪ বর্গকিলোমিটার। যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় দশ ভাগ। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অন্যতম বৃহত্তম বনাঞ্চল। আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় দেশের বনাঞ্চলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
একটি দেশের জন্য যতটুকু বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন তার চাইতেও অনেক কম বন রয়েছে আমাদের। আর যা আছে তা-ও দিন দিন উজার হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা পাহাড়ী এলাকার যে দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ার কথা কিন্তু সেরকম দৃশ্য এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। পাহাড়ে, এখন আর সেই প্রাকৃতিক নিবিড় ঘন বন নেই, প্রাচীন কোন গাছ পালা নেই। যে বনে বাঘ, হরিণ, হাতি, শিয়াল, সাপ, পাখ-পাখালির আস্তানা থাকার কথা সে বন পাহাড় এখন চা বাগান, আম বাগান অথবা লিচু বাগানে রূপান্তর হয়ে গেছে। সেখানে পাখিদের বিচরণের কোন সুযোগ নেই। বণ্যপ্রাণীর বেঁচে থাকার নূন্যতম কোন পরিবেশ নেই। এটা সত্যিই খুব উদ্বেগের বিষয় বৈকি।
পাহাড়ী এলাকায় যাতায়াতের সময় যখন রাস্তার দুপাশে তাকাই তখন পাহাড়ের এই করুণ চিত্র আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। পাহাড়গুলো যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে! এইতো, মাত্র কয়েক বছর আগেও যখন এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতাম তখন কেমন যেন রোমাঞ্চকর ছিলো পাহাড়ের দৃশ্যগুলো! পথ চলতে চলতে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এর আরণ্যক উপন্যাসের গল্পের সাথে দৃশ্যগুলোকে মিলাতাম মনে মনে। সেই গা ছমছম করা পাহাড়ী পথের ছবি আঁকতাম কল্পনায়। কিন্তু সেই পাহাড়, সেই বন- আজ কোথায়? এক সময় এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ১৫৬০টিরও অধিক সম্পূরক উদ্ভিদের সন্ধান ছিলো যার মধ্যে অন্তত ৬০০টি ছিলো বৃক্ষ প্রজাতি। কিন্তু আজ সেসব কোথায় হারিয়ে গেলো? এ বিষয়গুলোর কোন সঠিক জবাব কারো কাছে আছে কি?
গাছপালা আমাদেরকে দিচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ, ঘর বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম। কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেনও সরবরাহ করছে। ঝড় জলোচ্ছাস প্রতিরোধে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত কমাতে ও এর গতির তীব্রতা কমাতেও বিরাট ভূমিকা পালনে সহায়ক আমাদের এই গাছপালা। এছাড়াও বজ্রপাত ও ভূমিক্ষয়রোধেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর প্রচুর পরিমাণে গাছপালা বা বনাঞ্চল না থাকলে আমাদের বন্য পশু পাখি, প্রানীরা সব হারিয়ে যাবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে।
আমি গত কয়েকবছর ধরে পাহাড়ে কৃষি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। দেখছি, আমাদের কৃষি খামারের আশে পাশের সবগুলো পাহাড়ের চেহারা প্রায় একই রকম। সবুজ পাহাড়ের সব ধরণের গাছপালা কেটে একদম পরিস্কার করে ফেলা হয়েছে। দেখে মনে হবে যেন মরুভূমির কোন অঞ্চল এটি। ছোট ছোট লতা-গুল্ম, ঘাস- এসবও ঘাসমারা বিষ প্রয়োগে ধ্বংস করা হয়েছে। কি নির্দয় আচরণ! পরিবেশ প্রকৃতি বিশারদ ও নিরাপদ খাদ্য গবেষক কাজী জিয়া শামস্ একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- এই ঘাস, লতা-পাতা যেগুলোকে আমরা আগাছা বলে ধ্বংস করছি সেগুলোতো অন্তত:পক্ষে আমাদের জন্য প্রতিনিয়ত অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে। আর এসব আগাছা তো আমাদের গরু-ছাগল, ভেড়া-মহিষসহ গবাদি পশুর খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের অতি বানিজ্যিক চিন্তার বলি হচ্ছে আমাদের এসব পাহাড়-পর্বত-বন-নদী।
বানিজ্যিক বাগান তৈরি করতে আমরা আমাদের বন এবং বনজ সম্পদকে ইচ্ছেমতো ধ্বংস করছি। ঘর-বাড়ি, রিসোর্ট, শিল্পকারখানা তৈরী করতেও বন ও পাহাড় কেটে উজাড় করা হচ্ছে। মানুষের রান্নার কাজে লাকরি হিসাবে ব্যবহত হচ্ছে বনের কাঠ। ঘরের আসবাবপত্র তৈরীতে নিঃশেষ হচ্ছে পুরনো সব গাছ পালা। ইটের ভাটার জালানি যোগাতে প্রতিনিয়তই বন উজার হচ্ছে। এছাড়া ইট তৈরীতে মাটির উপরিভাগের অংশ কেটে নেয়ার ফলে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। কমছে কৃষি উৎপাদন। সংরক্ষিত বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাত কল নিষিদ্ধ হলেও তা কেউ মানছে না। ফলে বন ধবংসের এই মহাযজ্ঞ কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
বনভূমি রক্ষায় সরকারি আইন আছে। আইনের ফাঁক ফোকর দিয়েই অবাধে পাহাড় প্রকৃতিকে ধ্বংসের কাজ করছে সবাই। অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন ও বাগান সৃজনের ফলে আশংকাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে বনভূমির পরিমাণ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রাণী, প্রাণবৈচিত্র। একসময় আমাদের এই পাহাড়ে ছিলো হাজারো রকমের গাছ-পালা, উদ্ভিদ, লতা-গুল্ম। ছিলো নানা রকম কাঠের গাছ, ফলের গাছ, ভেষজ ও ঔষধি গাছ। অতি লোভে আমরা সব শেষ করেছি।
প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে, বন উজার করে, নদী-খাল-ছড়াকে বিপন্ন করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে অসুস্থ পরিবেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমরা। আর এর ফলে নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে আমাদের উপর। ইদানিংকালে বজ্রপাত, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পাহাড় ধস, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আর এজন্য একমাত্র আমরাই দায়ী, একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
গত বছরের কথা। বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রবক্তা, মুনসীজি এর প্রধান নির্বাহী জনাব মুনসী গিয়াস ভাইয়ের সাথে সাজেক সফর করছি। সকালে নাস্তা খেতে খেতে গিয়াস ভাই হঠাৎ প্রসঙ্গক্রমে বললেন- দেখেছো আমিন, এতো এতো পাহাড়, বাগান, গাছপালা কিন্তু এখানে তেমন একটা পাখির দেখা নেই? বিষয়টি উদ্বেগের নয় কি? গিয়াস ভাইয়ের মুখ থেকে কথাটি শুনে আমি দারুনভাবে বিশ্মিত হয়েছিলাম। আসলেই তো তাই। এই পার্বত্য এলাকার প্রতিটি অঞ্চলইতো পাখ-পাখালির কলরবে সরব থাকার কথা। কিন্তু কেমন যেন একটা হাহাকার বিরাজ করছে সর্বত্র। পাহাড়ের প্রাচীন সব গাছপালা কেটে বানিজ্যিক বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে বনের পাখিরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। আর পোকামাকড় দমনের জন্য কয়েকদিন পর পর যে পরিমাণ বিষ ছিটানো হয় তাতে করে পাখিসহ বনের অন্যান্য প্রাণীদের বেঁচে থাকাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। আর এক শ্রেণীর মানুষ তো আছেই যারা চরম উম্মাদনায় পাখি শিকার করে চলছে। এভাবেই প্রকৃতি ও প্রকৃতির নানা অনুসঙ্গকে ক্রমাগত ধ্বংস করে দিচ্ছি আমরা।
পৃথিবীর সকল জীবের বেঁচে থাকার মূল উপাদান হলো গাছপালা আর সবুজ বনাঞ্চল। পরিবেশ প্রকৃতি এবং জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য ঠিক রাখতে কোন দেশের মোট ভূমির ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমি আছে মাত্র ১৫.৫৮%। পৃথিবীতে মাথাপিছু বনভূমির পরিমান হলো ০.৬২ হেক্টর। যা ১৯৬০ সালের তুলনায় মাত্র অর্ধেক। আর বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র ০.০১৫ হেক্টরেরও কম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও যেটা ছিলো প্রায় ০.৩৮ হেক্টর এর মতো। আমরা আমাদের সুন্দর এ পৃথিবীকে কিভাবে ধ্বংস করে চলেছি এটা তার একটা ছোট্ট নমুনামাত্র।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বিশ্বের সকল দেশকে বনভূমির পরিমাণ ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অথচ সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি অবস্থানেও আমরা এখন নেই। আমাদের সচেতনতাই পারে সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে এগিয়ে নিতে। এজন্য সরকারি বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকার কারণেই প্রতিনিয়ত নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্বীকার হচ্ছি আমরা। নদীর নাব্যতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, পাহাড়ে ভূমি ধস হচ্ছে হরহামেশাই, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিন দিন পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দূষিত হচ্ছে বায়ু। বায়ু দূষণের ফলে বাড়ছে নানা রোগব্যাধী, ফুসফুস এবং এলার্জিজনিত বিভিন্নরোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে- কেবলমাত্র বায়ুদূষণে বিশ্বব্যাপি প্রায় ৭০ মিলিয়ন লোক মারা যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন- কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারলে ২০৩৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা এখনকার তুলনায় ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ২০৫১ সালে তা আরও ২ ডিগ্রী বাড়ার আশংকা রয়েছে।
ভয়াবহ এই পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে আমাদেরকে আবারও সবুজ পৃথিবী গড়ায় মনযোগী হতে হবে। নিজ নিজ এলাকায় পর্যাপ্ত গাছ লাগিয়ে, প্রাচীন বন পাহাড়কে সংরক্ষণ করে সবুজের এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। এই কাজগুলো আমাদেরকে করতে হবে আমাদের নিজেদের জন্যই, আমাদের সুস্থতা আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যই। আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে যে, আমরা বহু অর্থ ব্যয় করে আরাম আয়েশ আর বিলাসিতার জন্য সুরম্য অট্টালিকা বানাতে পারবো কিন্তু গাছপালা, পাহাড় প্রকৃতি বনাঞ্চল না থাকলে সুস্থভাবে বাঁচার আর কোন উপায় থাকবে না।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সেফ ফুড এলায়েন্স
Discussion about this post