এশিয়া, ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুট লোহিত সাগর। সমুদ্রপথটিতে হামলা অব্যাহত রেখেছে ইয়েমেন সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। এর সঙ্গে নতুন উদ্বেগ যোগ করেছে সোমালিয়া উপকূলে সোমালি জলদস্যুদের সক্রিয় হয়ে ওঠার ঘটনা। খবর দ্য স্ট্রেইট টাইমস।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী যখন হুথিদের আক্রমণ সামলাতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সুযোগেই জাহাজ ছিনতাইয়ে নেমেছে সোমালি জলদস্যুরা।
সম্প্রতি লোহিত সাগরের কাছে সোমালি উপকূলে বাংলাদেশী পতাকাবাহী একটি জাহাজ ছিনতাই করে সোমালি দস্যুরা। এমভি আব্দুল্লাহ নামের কয়লাবোঝাই জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে যাচ্ছিল। জাহাজটি ছিনতাইয়ের পর ২৩ বাংলাদেশী ক্রুকে জিম্মি করে দস্যুরা।
এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বুলগেরিয়ান বাল্ক ক্যারিয়ার রুয়েন ছিনতাই করে সোমালি দস্যুরা। ওই জাহাজে থাকা ১৭ ক্রুকে ভারতীয় নৌবাহিনী সম্প্রতি জীবিত উদ্ধার করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো জানিয়েছে, সোমালিয়ার জলদস্যুদের উৎপাত বেড়েছিল ২০১১ সালে। ওই বছর ২৩৭টি জাহাজে হামলা চালায় তারা। জিম্মি করে শতাধিক মানুষকে। সে বছর ওশেনস বিয়ন্ড পাইরেসি মনিটরিং গ্রুপ জানিয়েছিল, জলদস্যুতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েক মিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছিল মুক্তিপণ।
সম্প্রতি দুই সোমালি জলদস্যু রয়টার্সকে বলেছে, প্রায় এক দশক নিষ্ক্রিয় থাকার পর দস্যুতায় ফিরেছে তারা। মূলত হুথি হামলার কারণে সৃষ্ট সংকটের সুযোগ নিয়ে দস্যুতা করছে তারা।
শিপিং কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২০টিরও বেশি জাহাজ ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এতে সমুদ্রপথে ঝুঁকি ও খরচ বেড়েছে। খরচের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী, বীমার প্রিমিয়াম ও ক্রুদের বেতন। এর সঙ্গে রয়েছে মুক্তিপণের অর্থ। ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় ক্রু ও কার্গোর জন্য নিরাপদ পথ নিশ্চিত করতে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে কোম্পানিগুলো। এতেও বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে পণ্যবাজারে।
জাহাজ পরিচালনার চ্যালেঞ্জ এমন সময় বাড়ছে, যখন কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে লোহিত সাগরের সুয়েজ খাল এড়াতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে তারা দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানিয়েছে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সুয়েজ খাল দিয়ে পরিচালিত বাণিজ্য প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে উত্তমাশা অন্তরীপের চারপাশে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭৪ শতাংশ কার্গো বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সশস্ত্র হুথি গোষ্ঠী ও জলদস্যুরা জাহাজের ওপর হামলা বাড়নোর কারণে আসবাব থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তে পারে। সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে এক বিবৃতিতে তারা বলেন, প্রভাব এখন পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে। তবে আগামী মাসগুলোয় কিছু পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যেতে পারে। এটি দেখে ব্যবসায়ী কিংবা ভোক্তা কারোরই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ইউনাভফোর মিশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডেন উপসাগর ও সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এ তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, এ মাসে বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর জলদস্যুরা আরো দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে দস্যুতা চালাতে পারে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের সেক্রেটারি জেনারেল আর্সেনিও ডমিনগুয়েজ শিপিং কোম্পানিগুলোকে আফ্রিকার উপকূলে জলদস্যুতার জন্য উচ্চ সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন।
জলদস্যুদের প্রতিরোধে এক দশক আগে শিপিং কোম্পানিগুলো জাহাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল। ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী জলদস্যু নির্মূল অভিযানে যোগ দিয়েছিল। ১৪টি দেশের ২০টির মতো যুদ্ধজাহাজ এডেন উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে জাহাজ চলাচলের রুটগুলোয় টহল দিত। কখনো কখনো ভূমধ্য সাগর ও লোহিত সাগরেও এ টহল চলত।
Discussion about this post