ভ্রমণপিপাসুদের মনের সব ধরনের চাহিদা মিটে যায় পার্বত্য জেলা বান্দরবান গেলে। এই জেলায় আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। ইতিহাস অনুসারে, কোনো এক সময় এ অঞ্চলে বানরের বসবাস ছিল চোখে পড়ার মতো। শহরের প্রবেশমুখে ছড়ার পানি পার হয়ে পাহাড় থেকে লবণের লোভে বানরেরা আসতো দলবেঁধে। ছড়ার পানি বেড়ে গেলে পাহাড়ে ফেরার সময় তারা একে অপরের হাত ধরে পানি পার হতো। তা দেখতে অনেকটা বাঁধের মতোই দেখাতো। সেখান থেকেই লোকমুখে ওই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় বান্দরবান।
এই অঞ্চলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য হাতে কমপক্ষে ২-৩ দিন সময় রাখতে হবে। মাত্র ১-২ দিনের সফরে বান্দরবান ঘুরে শেষ করা সম্ভব নয়। বান্দরবানে আছে মেঘলা, নীলাচল, নাফাখুম, দেবতাখুম, কেওক্রাডং, ডিম পাহাড়, স্বর্ণমন্দির, থানচি, চিম্বুক, বগালেক, শৈলপ্রপাত, তিন্দু, মারায়ন তং, নীলগিরিসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।
বাংলাদেশের অতি পরিচিত ঝরনাগুলোর মধ্যে শৈলপ্রপাত অন্যতম। পর্যটননগরী বান্দরবানের কাছে হওয়ায় সারা বছরই পর্যটক সমাগমে মুখরিত থাকে স্বচ্ছ ও ঠান্ডা পানির এই ঝরনা।
সেখানে সময় কাটিয়ে আমরা দ্বিতীয় গন্তব্য নীলগিরির পথে ছুটলাম। নীলগিরি বান্দরবান জেলায় অবস্থিত একটি পাহাড় ও জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। নীলগিরিকে বলা হয় বাংলাদেশের দার্জিলিং। যেখানে গেলে মেঘের খেলা দেখার জন্য আর ভারতের দার্জিলিং যাওয়া লাগে না। নীলগিরি পাহাড়টি বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উঁচুতে। এই পাহাড়ের চূড়ায়ই আছে সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি ‘নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্র’। নীলগিরিতে সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট থাকায় সবাইকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চেক করে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়।
চেক পোস্ট পেরিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে লাগলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। চারপাশে সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে দূর আকাশে দেখা যায় কোথায় কোথায় ও হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ার দৃশ্য। যা দূর থেকে দেখার আনন্দ ভিন্ন রকমের। নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্রে ঢুকতে টিকিট বাবদ জনপ্রতি ৫০ টাকা ও গাড়ির জন্য আলাদা ৩০০ পার্কিং ফি নেওয়া হয়।
নীলগিরি যাওয়ার পথে রাস্তের দু’ধারেই পাহাড়, পাহাড়ের বুকে অসংখ্য কলাগাছের চাষ হয়। পথিমধ্যে পরিশ্রমী পাহাড়ি মানুষদের দেখা যায়। অনেকের হাতে দেখা যায় দা-কোদাল। এক লেনের রাস্তায় তীব্র গতিতে ছুটে যায় চান্দের গাড়ি। পাহাড়ি রাস্তার দুই থেকে আড়াই হাজার ফুট নিচেও দেখা যায় চোখ ধাঁধানো মোলায়েম সবুজ দৃশ্য। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরি ৪৬ কিলোমিটার দূরের ভ্রমণ। দু’ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয় সেখানে পৌঁছাতে। নীলগিরিতে বেলা ১১টার পর মেঘ চোখের সামনে কুয়াশার মতো উড়তে শুরু করেছিল। একদম স্বচ্ছ একটা পরিবেশের সাক্ষী হওয়ার জন্য বান্দরবান যাওয়া উচিত।
নীলগিরি ভ্রমণ শেষ করে যখন রওনা দিলাম শহরের দিকে তখনই পথিমধ্যে পড়ে চিম্বুক পাহাড় ও মেঘলা। আমরা ২০-২৫ কিলোমিটার আসতেই পাহাড়ি সাঙ্গু নদী উঁকি দিচ্ছে। কী মনোলোভা! মিলনছড়ি পর্যন্ত সাঙ্গুর এমন কোমনীয় দৃশ্য মন ভরিয়ে দেবেই। এরপরেই চিম্বুক পাহাড়।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফুট। চিম্বুক বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। একটু উপরে উঠতেই চোখ ছানাবড়া। পাহাড় আর পাহাড়! আহা, কী সুন্দর।
মনে হবে পুরো বাংলাদেশকে চিম্বুক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এক মহূর্তে উপভোগ করতে পারবেন। এত সুন্দর আমাদের এই দেশ, চিম্বুক পাহাড়ে না এলে জানতামই না। এবার চিম্বুক থেকেও নেমে যাওয়ার পালা। দুর্ভাগ্যজনক হলো আমাদের সময় কম হওয়ায় আর মেঘলায় যাওয়া হয়নি। তাই সরাসরি আমরা চলে গেলাম শহরে। সেখান থেকে নীলাচল।
নীলাচল: এটি বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এখানে নীলাচল পর্যটন কমপ্লেক্স বান্দরবান জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ার পাহাড় চূঁড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় এই পর্যটনকেন্দ্র। নীলাচলকে বাংলার দার্জিলিং বললে বোঝা যায় এর সৌন্দর্য। ২০০৬ সালের পহেলা জানুয়ারি এই প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। এ প্রকল্পে রয়েছে ‘শুভ্রনীলা’, ‘ঝুলন্ত নীলা’, ‘নীহারিকা’ ও ‘ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট’ নামে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বিশ্রামাগার। কমপ্লেক্সের মাঝে বাচ্চাদের খেলাধুলা ও বসার ব্যবস্থা আছে।
পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাজানো হয়েছে এ জায়গাগুলো। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সামনের পাহাড়ের দৃশ্যও ভিন্ন রকম। একটি থেকে আরেকটি একেবারেই আলাদা, স্বতন্ত্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উঁচু এই স্থানে বর্ষা, শরৎ কি হেমন্ত- তিন ঋতুতে ছোঁয়া যায় মেঘ। নীলাচল থেকে সমগ্র বান্দরবান শহর একনজরে দেখা যায়।
মেঘমুক্ত আকাশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অপূর্ব দৃশ্য নীলাচল থেকেই পর্যটকরা উপভোগ করতে পারেন। নীলাচলের বাড়তি আকর্ষণ হলো সেখানকার নীলরঙা রিসোর্ট। নাম ‘নীলাচল স্কেপ রিসোর্ট’। সাধারণ পর্যটকদের জন্য এ জায়গায় সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুমতি আছে। সকালে নীলাচলে মেঘের খেলা দেখলে কারো মন চাইবে না আর বাড়ি ফিরতে। নীলাচলে চারদিকের সবুজ গাছপালা, শীতল আবহাওয়া, বিভিন্ন রঙিন গাছ ইত্যাদি। সব কিছু মিলে নীলাচল যেন বাংলাদেশের জন্য এক অপরূপ দান। এত সুন্দর হতে পারে পাহাড়! যদি নীলাচল কেউ না আসে সে কখনো বুঝবে না। পরিবেশ আর আবহাওয়ার এতটা মিল কীভাবে হয়! নীলাচলের সৌন্দর্য ভাষায় ব্যাখ্যা করা সত্যিই কঠিন।
Discussion about this post